ছোটগল্প

কবি কিংবা প্রেমিক – আল শাহারিয়া

কবি কিংবা প্রেমিক তরুণ লেখক আল শাহারিয়ার লেখা ছোট গল্প। আশা করি আপনারা উপভোগ করবেন।

কবি কিংবা প্রেমিক

এ শহরে কবিতায় গল্প লেখা হয় আবার উল্টোটাও হয়। আকাশ-মেঘে বৃষ্টি এলে কিশোর-কিশোরীর নবযৌবনা প্রেম যেন আরেকটু উদ্দীপ্ত হয়ে ডানা মেলে আকাশে। তখন শহুরে রিক্সার প্রায় সত্তর শতাংশ ওদের দখলে থাকে। ওরা একগুচ্ছ কদমে আর চিনি ছাড়া বৃষ্টি মেশানো দুধ চা’য়ে চুমুক দিয়ে কি যেন এক অবিরাম উষ্ণতা খুঁজে পায়। আকাশ-নীলার গল্পটাও এমনকিছু ছিলো। এক শ্রাবণ বৃষ্টি শেষে ভাদ্রের শুরু। ইংরেজি মাস-বছর ঠোঁটের ডগায় রাখা ছেলেটি সবেমাত্র বাংলা মাস-বছরের খোঁজ রাখা শুরু করেছে। কারণ‚ মেয়েটি বাঙলা প্রেমী এবং বাঙলা কবিতা প্রেমী। আকাশ ভাবলো নীলা যেহেতু কবিতা ভালোবাসে সেহেতু তাঁরও উচিত কবিতাকে ভালোবাসা। কবিতাকে হৃদয়ে ধারণ করা। কবিতার সাগরে ডুব বা সাঁতার দেওয়ার মতো দুঃসাহস তখনও আকাশের হয়নি। প্রভাতের নতুন আলোয় ঘুম ভাঙা চোখে পদার্থবিজ্ঞানের জটিল সমস্যা পাশে ফেলে রেখে সে বাংলা সাহিত্য পড়তো। এভাবে দিন যেতে লাগলো। সে ধীরে ধীরে অনুভূতি খাতায় লিখতে শুরু করলো। দেখলো তা অকবিতার রূপ নিচ্ছে। তাঁর তখন বাংলা সাহিত্যের প্রতি গভীর একটা টান তৈরি হয়ে গিয়েছে। রাত জেগে প্রেয়সীকে ভেবে ২-১০ লাইন লিখে ফেলা তাঁর নিত্যদিনের কাজ ছিলো। নীলার কাছ থেকে বাহবাও পেত খুব। কিন্তু‚ প্রেম বা নীলা’কে ছাড়া আর কোনো বিষয়ে তাঁর কলম নড়তো না। মস্তিষ্ক যেন প্রেয়সীর চিন্তায় মগ্ন। এই মহাপৃথিবীর অন্য কোনো বিষয়েই তাঁর ভ্রুক্ষেপ নেই।

সাগর বিজয়ে ও আমেরিকা আবিষ্কারে মুসলমান- বাসার মঈনউদ্দীন

এভাবে কয়েকবছর গেলো। আকাশ তখন ধীরে ধীরে প্রেমিক থেকে কবি হয়ে উঠতে লাগলো। কবিতার মাঝে প্রেমিকার পাশাপাশি দেশ-দশ-সময়ের দেখা পেলো। কবিতা যে বিশাল বিস্তৃত বিষয় তা বুঝতে ওর কষ্ট হলো না। এই পৃথিবী’সহ সমগ্র মহাবিশ্ব কবিতার নিয়ন্ত্রণে। বুঝতে শুরু করলো কবিতা মানে শুধুমাত্র প্রেমিকার কথা নয়। প্রেমিকা বা প্রেম হলো কবিতার একটা অনুচ্ছেদ মাত্র।

নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর চারিপাশে নতুন পরিবেশ। নতুন শহর। নতুন আলো। সেই আলোয় এসে ওর ঝলমলে চোখ দু’টো সবুজকে হারিয়ে ফেলল। অভিসার পেলেও প্রশান্তি যেন আকাশকে আর ছুঁয়েও দেখলো না। আজীবন সবুজকে বুকে ধারণ করা মানুষের বেশি রঙিন দুনিয়া পছন্দ হয় না। প্রেমিকার চুলের বিদেশি শ্যাম্পুর গন্ধ পেলেও সেই পৌষের ধানের গন্ধ এ শহরে পাওয়া যায় না। এখানে ঘুমময় রাত বলে কিছু নেই। দিনের চেয়ে রাতেই বেশি মানুষের চোখ মেলে থাকার দৃশ্য দেখা এ শহরের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। নানারকম রঙিন আলোর ভিড়ে অনন্য সুন্দর চাঁদের রুপালি আলো এ শহরে প্রবেশ করতে পারে না। অথচ শৈশবে এসবের সাথে আকাশের এক গভীর সম্পর্ক ছিলো। ন’টা বাজতেই বিছানায় মাথা পেতে রাখলে তালগাছের কাঠ দিয়ে বানানো জানালার ফাঁক দিয়ে জোৎস্না ওকে ছুঁয়ে দিতো। জোৎস্নার সাথে লুকোচুরি খেলা হতো প্রতি পূর্ণিমায়। আবার কখনওবা বিশাল বিশাল গাছে ভরা নির্জন অরণ্য ওর পূর্ণিমা রাতের সাক্ষী হয়ে থাকতো। বড় বড় গাছের ফাঁক দিয়ে জোৎস্না যেভাবে মাটিতে গড়িয়ে পড়তো সে দৃশ্য অপরূপ সুন্দর। ওর স্মৃতিকে প্রায়শই নাড়া দিতো এসব। সারাদিন কন্সার্ট‚ কনফারেন্স‚ ক্যাফেটেরিয়া‚ স্টেডিয়াম‚ পার্ক আর চায়ের কাপে অকৃত্রিমতা খুঁজে বেড়াতো সারাক্ষণ। যা কিছু অকৃত্রিম খুঁজে পেয়েছিলো তাঁর মধ্যে অন্যতম ছিলো বন্ধুদের ভালোবাসা। কিন্তু‚ ওর সবুজকে কোথাও আর খুঁজে পায়নি।

একটা সময় নাগরিক কবি হয়ে আত্মপ্রকাশ হলো আকাশের। শহরের গ্রাফিতি থেকে রিক্সার পেইন্টিং তখন আকাশের কবিতায় বড় স্থান দখল করে নিলো। ও বুঝতে পারলো নীলা ওর কবিতার খাতার খুব সামান্য স্থান দখলে রেখেছে বা রাখতে পেরেছে। মানুষ আসলে পরিস্থিতি অনুযায়ী অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিজের জীবাত্মাকে কিছুটা হলেও পরিবর্তন করে নেয়। কিন্তু‚ এ কাজ দ্রুত হয় না। আকাশও বিভিন্ন রকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে নিজেকে পরিবর্তন করতে শুরু করেছিলো। প্রতিনিয়ত নতুন কিছু শেখা‚ জানা আর দেখার মধ্য দিয়ে ওর দিন যাচ্ছিলো।

নীলার বন্ধুমহল ছিলো আকাশের থেকে অনেক বড় এবং আধুনিক। ওদের কাছে শহুরে মানেই আধুনিক। আকাশের চিরপরিচিত কবিতাপ্রেমী মানুষটি কবিতাকেই ভুলে গিয়েছে দেখে কষ্ট যেন বুকের ভিতর মন্ত্রীর আসন ছেড়ে রাজার আসনে বসলো। নীলার কণ্ঠে আর কখনও আকাশের অাবৃত্তি শোনা হয়ে ওঠেনি। নীলাদের আড্ডায় মাঝেমাঝে আকাশ উপস্থিত থাকতো। বাধ্য কবুতরের মতো চেয়ারে বসে থাকা আর দু-এক কাপ চা পান করা ছাড়া তাঁর আর তেমন কোনো কাজ ছিলো না সেখানে। নীলা আর তাঁর বন্ধুদের উচ্ছ্বাস দেখে ওর মনে পড়ে যেত ছোটোবেলার বৃষ্টিমুখর দিনে বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলার কথা। একটামাত্র ফুটবল আর নড়বড়ে গোলপোস্ট নিয়ে মায়ের চোখ এড়িয়ে ওদের খেলা চলতো। কর্দমাক্ত মাটিতে একজন পা পিছলে পড়ে গেলে নিজের দলের খেলোয়াড়রা পর্যন্ত হাসিতে গড়িয়ে পড়তো। সে-কি অকৃত্রিম উচ্ছ্বাস। ওখানে কেউ কাঁদতো না। কাঁদলেও বৃষ্টি কান্নাটা বুঝতে দিতো না। ও বিশ্বাস করে যে ওর শৈশব অনিন্দ্য সুন্দর ছিলো।

আস্তে আস্তে নীলার সাথে দুরত্বের শুরু এবং কবিতার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় হতে লাগলো। প্রেম বলে কিছু আর তখন আকাশের অনুভব হতো না। প্রেম মানে রোজ বিকেল পাঁচটায় দেখা করা‚ প্রেম মানে মুঠোফোনের বেহিসেবী আলাপন‚ প্রেম মানে একে অপরের খবর নেওয়া এসবের কিছুই ছিলো না। কেবল নামমাত্র একটি সম্পর্কের বন্ধন বা দেয়াল ছিলো। ও বুঝলো এ বন্ধন ভেঙে দেওয়া আবশ্যক। প্রেম হলো আইন্সটাইনের Theory of Relatively এর মতো আপেক্ষিক। প্রেম মূলত দু’জনের পরষ্পর স্বার্থত্যাগ‚ বিশ্বাস এবং ভালোবাসার উপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। এসবের কিছুই সে খুঁজে পাচ্ছিলো না। সম্পর্কটা শূন্যে পূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। নিরবেই ভেঙে গেলো ওদের প্রেম। কেউ কাউকে আটকায়নি। যে যার মতো উল্টো পথে হেঁটে গিয়েছে বহুদূর। হয়তো ভালোবাসাটা বাষ্পের মতো আগেই উড়ে গিয়েছিলো বলে সম্পর্কের বিচ্ছেদের শুরুতে কেউই আঘাত অনুভব করিনি। কোনো পিছুটান ওদের জোড়া লাগাতে পারিনি।

দু’মাস পর হঠাৎ মধ্যরাতে আকাশের ঘুম ভেঙে যায়। টিকটিক ঘড়ির আওয়াজ আর কলোনির দূরের কোনো বাড়ি থেকে ভেসে আসা আধুনিক গান ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না। সেদিন ছিলো ভরা পূর্ণিমা। ও বুঝলো সবুজ ওকে ডাকছে। ততদিনে ওর একটা বাইক হয়েছে। এই রাত-বিরেতেই বেরিয়ে পড়লো একটু নির্মল প্রশান্তি পেতে।

শহরের সাথে সব লেনাদেনা চুকিয়ে সে আবার সবুজে ফিরে যেতে চাইলো। সবুজে এক অদ্ভুত সুন্দর শীতলতা আছে যা সবাইকে স্পর্শ করে না। ওর সাথে চাঁদটাও যেন সবুজে যেতে চাইলো। চাঁদকে সাথে নিয়ে আকাশ পৌঁছে গেলো শৈশবের রুপালি স্মৃতিতে ভরা সেই ঘন অরণ্যে। সেই রাত‚ সেই চাঁদ তবু কিসের যেন কমতি। আজ অনেক পথ পাড়ি দিয়ে এসে আকাশ বুঝতে পারলো‚ কবিদের নিরবেই ভালোবাসা উচিত।

আরও পড়ুন

W Zaman

Recent Posts

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ -পিনাকী ভট্টাচার্য | Swadhinata Uttar Bangladesh by Pinaki Bhattacharya

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ(Swadhinata Uttar Bangladesh) পিনাকী ভট্টাচার্য(Pinaki Bhattacharya) এর লেখা একটি বই। এখানে তিনি বাংলাদেশ…

1 year ago

দ্য ট্যাংক ব্যাটল অব শিরোমণি -গাজী সাইফুল হাসান

দ্য ট্যাংক ব্যাটল অব শিরোমণি বা শিরোমণি ট্যাঙ্ক যুদ্ধ  খুলনার শিরোমণিতে হওয়া একটি যুদ্ধ। ১৬ ডিসেম্বর…

1 year ago

ইসলামী আকীদা -ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর(রহি.) | Islami Aqida

ইসলামী আকীদা(Islami Aqida) ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর(রহি.) রচিত গ্রন্থ। সম্ভবত আমরা অনুভব করছি যে, ঈমানের…

1 year ago

আল-ফিকহুল আকবার -ইমাম আবু হানীফা (রহি.) | আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (অনুবাদক)

আল-ফিকহুল আকবার ইমাম আবু হানীফা (রহি.) রচিত আকীদার বই। ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহিঃ) এই…

1 year ago

হাদীসের নামে জালিয়াতি – ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহি.)

হাদীসের নামে জালিয়াতি ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহি.) রচিত এক অসাধারণ গ্রন্থ। প্রচলিত অনেক বিষয় আমরা…

1 year ago

মরুভাস্কর -কাজী নজরুল ইসলাম | Morubhaskar by Kazi Nazrul Islam

মরুভাস্কর কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ। এই গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে। হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জীবনী…

1 year ago

This website uses cookies.